Hungry Prose and More: A Feast for the Literary Mind
- Murshid AM
- Feb 18
- 13 min read
Updated: Feb 27
Author :: Original Bengali by Mr. Murshid AM translated in English by Mr. Rishin Roy Chowdhury

Whether literature truly requires a movement for its evolution, or whether such movements organically emerge as inevitable forces shaping literary consciousness, remains a perennial debate. However, Bengali literature bears deep imprints of such movements, their tremors felt by both the discerning reader and the casual humorist alike. One such literary upheaval, known as the Hungry Movement, shook the foundations of Bengali literature in the 1960s, challenging the prevailing literary ethos. Though this article does not delve into its history, it seeks instead to explore its impact—especially on Bengali prose—and its lingering relevance today.
The emergence of the Hungry Wave was met with fierce resistance. As it gradually defied the established literary order, eminent writers and intellectuals rallied against it. Controversy, inextricable from its inception, became its shadow. The literary elite viewed it as an affront to the sanctity of art, a rupture in the disciplined cadence of modernist aesthetics. It was not long before internal fractures emerged, exacerbated by the machinations of certain literary gatekeepers.
From its inception, the Hungryalists sought to dismantle modern Bengali literary conventions, resisting the institutionalization of modernity itself. To them, modernity embodied all that was fixed—structured, canonical, power-centered, harmonious. In opposition, they championed the anti-institutional, the dissonant, the fluid, the irreverent. A handful of poets and thinkers embarked on a radical linguistic experiment, not intending to forge a movement but to rupture literary norms. In their defiance, they turned to a nascent form of postmodernism—not as a defined era, but as a symptom of cultural discontent.
Postmodernity, with its labyrinthine theories and contested interpretations, was not a period but an impulse, a seismic undercurrent shifting the literary landscape. The Hungryalists embraced this disorder, injecting an unprecedented fervor into Bengali prose, poetry, and drama. Their language was a blade—razor-sharp, unrelenting, piercing the soul of tradition. They sought to strip language of unnecessary ornamentation, rejecting the contrived dialogues of characters sculpted by the author’s hand. With the death of the author—echoing Roland Barthes—the text belonged to the reader alone, who was now sovereign in deriving meaning. Unlike modernist authors who positioned themselves as the custodians of knowledge, dictating thought, the Hungryalists exalted the reader’s freedom.
Scholar Marina Reza, in her research on the Hungryalist movement, observes:"The Hungryalists interrogated the authenticity of the language employed in popular Indian literature and felt as though the language of Indians from lower castes and classes was not being adequately represented at all… they saw history linearly and believed themselves to be at the forefront of the literary scene, whereas those from subordinate sections of society were ‘backwards’.” (Space and the Pages: Addas with the Hungryalist Poets, 2012)
This disruption finds further resonance in the words of Malay Roychowdhury, one of the movement’s pioneers. He describes the Hungryalist vision as a counter-context—a rebellion against the dominant literary discourse of the time:"The contrast of discourse, the shift of discursive practice, the variety of narrative-store, the difference of perception-tone, the difference of source of creation… The mainstream literary discourse was designed to enrich the personal wealth of the poet-writer. The Hungry activists, in contrast, sought to enrich the wealth of language, the wealth of speech, the wealth of rhetoric, the wealth of transgression… the wealth of linguistic irrationality, the wealth of paradoxical transformation, the wealth of the interspersed action of text.” (Hungry Legend, 2013)
This ideological rift extended into the very editorial policies of literary magazines such as Kavita, Dhrupadi, Krittibas, and Shatabhisha. These journals, Roychowdhury argues, were arbiters of bourgeois taste, excluding works that deviated from their aesthetic values. The absence of lower-class writers from their pages, particularly in poetry, was a testament to their selective cultural memory. To these literary gatekeepers, timelessness was theirs to define, for they viewed time itself as linear, positioning themselves at its vanguard.
Yet, for those who stood alongside Malay Roychowdhury in this movement, these ideas were not mere abstractions; they found visceral expression in their own works. As a result, the grand narrative that emerged within Bengali prose was no longer confined to the margins—it became a revolutionary force, unsettling the literary establishment and redefining the contours of Bengali literature.
Original Bengali
প্রসঙ্গ হাংরি গদ্য ও অন্যান্য
মুর্শিদ এ এম
সাহিত্যে আন্দোলন বলে কিছু হয় কি না, বা কোনো সাহিত্য-আন্দোলন সাহিত্যের উত্কর্ষের প্রয়োজনে লাগে কি না --এ তর্ক বহুধামুখী ও বহুকালিক। অথচ বাংলা সাহিত্য নানাভাবে আন্দোলনের আঁচ গায়ে মেখেছে এবং সাহিত্যপ্রেমী মাত্রেই জানেন, তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল ভোগ করেছে সাধারণ পাঠক তথা রসিকজন। ষাটের দশকে তেমন এক সাহিত্য-আন্দোলন সারস্বত সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, যার নাম হাংরি আন্দোলন। এর ইতিহাস আমাদের বর্তমান নিবন্ধে আলোচনার বিষয় নয়। কীভাবে এই ঘটনা বাংলা সাহিত্যে; বিশেষত বাংলা গদ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং আজও যা প্রাসঙ্গিক বলেই সেটি বুঝে নেওয়ার স্বল্পায়তন ভূমিকা নিবেদন করা হবে।
একটি প্রসঙ্গ উত্থাপন না-করলেই নয়, হাংরি ঢেউ যখন দিকে দিকে প্রচলিত সাহিত্য-মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল, তখন প্রথিতযশা লেখক তথা বুদ্ধিজীবী এর বিরোধিতায় তৎপর হয়েছিলেন। ফলে প্রথম থেকেই বিতর্ক, বিবাদ, এই আন্দোলনের পিছু ছাড়েনি। শিল্পের দিকে ছুড়ে দেওয়া এই আঘাত কেউই মানতে পারেননি। একসময় এর শিবির-বিভাজনও ঘটে গেল কিছু সাহিত্য-প্রমোটরের চক্রান্তে।
সুচনালগ্ন থেকেই হাংরিদের উদ্দেশ্য ছিল আধুনিক বাংলা ভাষা এবং আধুনিকতাবাদী মননকে আক্রমণ করা। আধুনিকতা অর্থে যা কিছু আপডেটেড বা বর্তমান--এভাবে বিষয়টিকে তাঁরা ব্যাখ্যা করেননি। আধুনিকতা মানে যা কিছু প্রাতিষ্ঠানিক, নিশ্চল, মূলস্রোত, ক্ষমতাকেন্দ্রিক, নিখুঁত, সুষম ছন্দ বা সঙ্গীত ইত্যাদি। যেগুলির বিপরীতে দাঁড় করানো যায়—প্রতিষ্ঠান-বিরোধী, তোলপাড়, জলবিভাজিকা, ক্ষমতাবিরোধী, প্রতিনিয়ত রিভাইজ, বেহিসেবী ছন্দ খরচ বা যে কোনো গান ইত্যাদি। সেই লক্ষ্যে কয়েকজন কবি-ভাবুক-চিন্তাবিদ তাঁদের নিজস্ব এক ভাষাকে সাহিত্যে প্রয়োগ করার কাজে ব্রতী হলেন। তাঁদের আদৌ উদ্দেশ্য ছিল না এমন যে, এটি একটি আন্দোলন নামে অভিহিত হোক। আধুনিকতাকে আক্রমণ করার প্রয়োজনে তাঁরা সাহায্য নিলেন উত্তর-আধুনিকতা-বিশিষ্ট এক নব্য জঁর-এর। জঁর বলা হল বটে, তবে এর ব্যাপকতা ততটা প্রতিষ্ঠিত ছিল না বা হয়নি, ফলে সর্বত্র এর সার্থক প্রয়োগ সফলভাবে করা যায়নি। আসলে উত্তর-আধুনিকতা বা অধুনান্তিকতা বা আধুনিকোত্তর, যে নামে ডাকা হোক, এ এক জটিল মতবাদ। নানা মুনির নানা মত। তাঁরা জানালেন, এটা কোনো কালখণ্ডের ব্যাপার নয়, এ হল সংস্কৃতির অন্দরে থাকা অনায়াস এক ধরনের লক্ষণ। যাই হোক, হাংরিরা গদ্য-কবিতা-নাটক, সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন এক ভাষা-প্রকরণ ব্যবহার করতে লাগলেন, যা ইতোপূর্বে বাংলা সাহিত্যের পাঠকের অগোচর ছিল। এক অভূতপূর্ব দ্রোহ এবং আর্তি সে-ভাষার শরীরে। এক তীব্র, তীক্ষ্ণ শাণিত অস্ত্রের মতো মর্মভেদী। এ-যাবৎকাল পাঠকৃতির এ-এক অভিনব মোচড়। তাঁদের বক্তব্য ছিল খুব পরিষ্কার। ভাষা যখন মানুষের ভাব বিনিময়ের মাধ্যম তখন তাকে অহেতুক জটিল করে তোলার কোনো দরকার নেই। সে-জটিলতা সাহিত্যে প্রয়োগের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে। চরিত্রের মুখের ভাষাকে লেখকের ক্যারদানিতে অতিরিক্ত রসসিঞ্চনের দিন বিগত। লেখককে; যখন বলা হচ্ছে, লেখাটা তৈরি হওয়ার পর তাঁর সত্তার অপসারণ ঘটে যাচ্ছে। লেখকের মৃত্যু ঘোষিত হচ্ছে (রলাঁ বার্ত স্মর্তব্য)। টেক্সট অংশটি তখন শুধুমাত্র পাঠকের। পাঠক যেভাবে খুশি তার মধ্য থেকে অর্থ নিষ্কাশন করে নেবে। হাংরিরা লেখক থেকে পাঠককে মর্যাদার আসনে বসালেন। আধুনিকতা যখন নাকি লেখককে তামাম জ্ঞানের গুণের মুনশিয়ানাকে উচ্চাসনে বসিয়েছে। লেখক যেভাবে ভাববেন বা ভাবাবেন তেমনটাই পাঠককে ভাবতে বাধ্য করা হবে--বিষয় এমন নয়। পাঠকের স্বাধীনতাকে তাঁরা গুরুত্ব দিলেন। হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট নিয়ে গবেষণারত লেখক মারিনা রেজা জানাচ্ছেন, “The Hungriyalist interrogated the authenticity of the language employed in popular Indian literature and felt as though the language of Indians from lower castes and classes where not being adequately represented at all. ... they saw history linearly and believed themselves to be at the forefront of the literary scene, whereas those from subordinate sections of the society were ‘backwards’.” ( Space and the Pages: Addas with the Hungryalist Poets, Merina Reza, 2012)
এখান থেকে আমরা নতুন এক স্বরের এলাকায় প্রবেশ করতে পারি। উপরোক্ত বক্তব্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারি হাংরি আন্দোলনের পুরোধা মলয় রায়চৌধুরী-র ব্যাখ্যাকে:
“... লেখালেখি থেকে সেই সময়কার প্রধান সাহিত্যিক সন্দর্ভের তুলনায় হাংরিরা যে প্রতিসন্দর্ভ গড়ে তুলতে চাইছিল, সে রদবদল ছিল দার্শনিক-এলাকার, বৈসাদৃশ্যটা ডিসকোর্সের, পালাবদলটা ডিস্কারসিভ প্রাকটিসের, বৈভিন্নটা কথন-ভাঁড়ারের, পার্থক্যটা উপলব্ধির স্বরায়নের, তফাতটা প্রস্বরের, তারতম্যটা কৃতি-উৎসের। তখনকার প্রধান মার্কেট-ফ্রেন্ডলি ডিসকোর্সটি ব্যবহৃত হত কবিলেখকের ব্যক্তিগত তহবিল সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। হাংরি আন্দোলনকারীরা সমৃদ্ধ করতে চাইলেন ভাষার তহবিল, বাচনের তহবিল, বাকবিকল্পের তহবিল,..নিম্নবর্গীয় বুলির তহবিল, সীমালঙ্ঘনের তহবিল... স্পৃষ্টধ্বনির তহবিল, ভাষিক ইরর্যাশনালিটির তহবিল, শব্দোদ্ভটতার তহবিল, বিপর্যাস সংবর্তনের তহবিল... পাঠবস্তুর আন্তঃস্ফোটিক ক্রিয়ার তহবিল... ইত্যাদি।” খানিক পরে বলছেন, “ সেসব পত্রিকাগুলির ( কবিতা, ধ্রুপদি, কৃত্তিবাস, শতভিষা ইত্যাদি) একটি সম্পাদকীয় বৈশিষ্ট্য ছিল। বুর্জোয়া মূল্যবোধ প্রয়োগ করে একে-তাকে বাদ দেয়া বা ছাঁটাই করা। যে-কারণে নিম্নবর্গের লেখকের পাঠবস্তু সেগুলোর পৃষ্ঠায় অনুপস্থিত, বিশেষ করে কবিতা। আসলে কোন কোন রচনাকে ‘টাইমলেস’ বলা হবে, সে জ্ঞানটুকু ওই মূল্যবোধের ধারক-বাহকেরা মনে করতেন তাঁদের কুক্ষিগত, কেননা সময় তো তাঁদের চোখে একরৈখিক, যার একেবারে আগায় আছেন কেবল তাঁরা নিজে।” ( হাংরি কিংবদন্তিঃ মলয় রায়চৌধুরী, ২০১৩)
মলয়ের সঙ্গে এই আন্দোলনে যাঁরা যাঁরা জড়িয়ে পড়েছিলেন আলাদা আলাদা মত নিলে জানতে পারা যাবে, তাঁরাও তাঁদের নিজস্ব রচনায় এই সমস্ত লক্ষণের উল্লেখ করে গিয়েছেন। তার ফলে বাংলা গদ্যে যে গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের জন্ম হয়েছিল এবং তার রাজত্ব কোনো প্রান্তিক গদ্যকারকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি, এ কথা স্পষ্ট। তাহলে মেনে নিতে হয় নমস্য তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা-সাহিত্যকে তাঁরা ততটা জমাট অনিবার্য স্মরণাতীত মনে করছেন না। অবশ্য রেহাই পেয়েছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর বিষয় নির্বাচনের কারণে, গভীরতর সামাজিক অসুখের নগ্ন চিত্র উপস্থাপনের কারণে। যখন নাকি বাকি দুই প্রখ্যাত লেখকের সাহিত্যকে মনে করা হয়েছে উপরিতলের ভাষ্য, দারিদ্র্য কিংবা অসহায় মানুষের ধারাবিবরণীকার। সাধারণ মানুষের সঙ্গে অন্বিত থেকে তাদের যন্ত্রণা আর সংকটকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে কেবল আবেগ আর শিল্পসৌকর্য দিয়ে কাজ চলে না। মানিকের ক্ষেত্রে তথাকথিত শিল্পীত না হলেও যতটা মানবিক ক্লেশের উদ্ঘাটক, বাকি দুই বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়--তা অনেকটাই অনুপস্থিত। পাশাপাশি পুঁইমাচা ও প্রাগৈতিহাসিক টেক্সটদুটি রাখলে এই বক্তব্যের কিছুটা আঁচ করা যাবে। যদিও গণদেবতা আর পথের পাঁচালী বিশ্বসাহিত্যে উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত। কিন্তু হাংরিদের বিচারে এঁদের পাশ কাটিয়ে উঠে এলেন পরবর্তী প্রজন্মের অপর সাহিত্যিকেরা। যাঁদের লেখায় প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার ছাপ ধরা পড়ল। যাঁদের রচনা হল প্রতিসন্দর্ভের নির্মিতি। যাঁরা নিম্নবর্গের কথা, নিম্নবর্ণের কথা তো লেখার বিষয়বস্তু করে নিলেনই, উপরন্তু সংশ্লিষ্ট যাপনকে ‘তুলে ধরা’র অভিনব দৃষ্টান্তের জন্যে বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক নতুন ধারার সূত্রপাত ঘটালেন। লেখক লেখাটির নিয়ন্তা আর রইলেন না। তিনি যা বোঝাতে চাইবেন পাঠবস্তুটির মাধ্যমে--সেটিই অন্তর্গত একমাত্র ব্যাখ্যা নয়। পাঠকই হয়ে উঠল পাঠবস্তুটির দিশা নির্ণায়ক। কেননা পাঠবস্তুটি কেবল গল্পবলিয়ের ভুমিকা পালন করেই ক্ষান্ত হল না, তা হয়ে উঠল বহুরৈখিক, বহুদিশাময়, রাইজোম্যাটিক। হাংরিরা দাবি করলেন, এটা প্যারাডাইম শিফট এর ঘটনা। এই নতুন জোয়ারের সূচনাকারীরা তাঁদের আন্দোলনের ফসল এবং তাঁদের মতবাদের অনুসারী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মতবাদ্গুলি হল, শাস্ত্রবিরোধী, ছাঁচ ভেঙে ফেলো, নিমসাহিত্য, নতুন নিয়ম ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্য লেখক ও কবি হিসাবে প্রতিভাত হলেন, বিনয় মজুমদার, মলয় রায়চৌধুরী, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুবো আচার্য, সমীর রায়চৌধুরী, সুবিমল বসাক, ফাল্গুনী রায়, উৎপল কুমার বসু, প্রদীপ চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, ত্রিদিব মিত্র, আলো মিত্র, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, শম্ভু রক্ষিত প্রমুখ বিশিষ্টজন।
দুই
তাহলে বোঝা যাচ্ছে সহজপাচ্য, চাপিয়ে দেওয়া, বশিকরণ মন্ত্রসঞ্জাত, ইয়োরোপীয় মহা আখ্যানবাদী, ছেলেভুলানো গোলগল্পের দিন সাহিত্যকৃতিতে ফুরিয়ে এল হাংরিদের হাত ধরে। তাঁদের গদ্য-রচনায়, প্রবন্ধ-নিবন্ধে, উপন্যাসে, ছোটগল্পে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। হাংরির পুরোধা মলয় রায়চৌধুরী লেখা শুরুর পূর্বে কোন পরিস্থিতির দাপটে নিজের লেখালিখিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবেন ভাবতে গিয়ে বলছেন,
“প্রতিটি মাস্টারমশায় ‘সোনার তরী’ থেকে একই সংকেত পাচ্ছেন দেখে মুখ বুজে স্তম্ভিত হয়ে যেতুম, মানেবইগুলোতেও একই কপচানি, হুবহু। উপনিবেশবাদী কাঠামোটি পুরোপুরি চারিয়ে দেওয়ার আবহ। বলা হত, কোনো কোনো পাঠবস্তু নাকি মহান এবং সর্বজনীন এবং তাইতে প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত হত মানবজীবনের সার্বিক সত্য, আর সেই জন্যে ভাষা সম্পর্কে পাঠকের বিশেষ জ্ঞান দরকার ছিল না। চিঠি বা অফিসের কাজের তুলনায় সাহিত্যের ভাষা যে আলাদা হয়, এমন শিক্ষা আমার শিক্ষকদের ছিল না। লেখক কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর জোর দিতেন সবাই। রচনাটির ঐতিহাসিক বা সামাজিক পৃষ্ঠভূমি, মানবিক আগ্রহ, কাল্পনিক প্রতিভা এবং কাব্যিক সৌন্দর্য : চণ্ডীদাস হেমচন্দ্র নবীনচন্দ্র মাইকেল বিহারীলাল রবীন্দ্রনাথ কালিদাস রায়—সব্বাইয়ের জন্যে একটাই থার্মোমিটার। তার মানে, সাহিত্য বুঝতে গেলে পার্থিব জগৎ সম্পর্কে সকলের গ্রহণযোগ্য ধারণাগুলোয় ঘা মারা চলবে না, এমনকি পাঠক হিসেবে আমাদের স্থায়ী পিঁড়িটা নাড়ানো চলবে না। ... টের পেতে থাকি যে, সবাই নিজেকে লুকিয়ে লেখকটাকেই মহান প্রমাণ করার তালে আছে, বঙ্কিমচন্দ্রকে, শরৎচন্দ্রকে। (কবিত্বের কালঘাম : কেন যে লিখি, প্রবন্ধ সংগ্রহ-১, ২০১১)
সুতরাং এইসব লেখকের গদ্যভাষা অন্য এক দিশার সন্ধান দেবে, এ আর তেমন অবাকের কিছু না। রচনার আওতা থেকে মানবিক কোনো অর্জনকেই তাঁরা বাদ রাখলেন না। এই জীর্ণ সময়ে যন্ত্রণাদগ্ধ সামাজিক মানুষের যাবতীয় সমস্যাকে বা কৌম সমুদায়ের চাওয়া-পাওয়ার এক্তিয়ারকে বিশদ করে তুললেন। অধিকারের প্রশ্নে, স্বতন্ত্রতার প্রশ্নে, জীবন-জীবিকাকে রাষ্ট্রচালিত হাঙরমুখো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রশ্নে, পরিবেশ-পরিস্থিতি সংরক্ষণের প্রশ্নে, এমনকি নিজস্ব যৌন আকাঙ্ক্ষার কামনা বাসনার চিরাচরিত প্যাটার্নকে অস্বীকার করার প্রশ্নে তাঁরা কোনো আপোশের কাছে লেখনিকে বন্ধক রাখলেন না। রচনাকে তাঁরা গণ্ডিবদ্ধতা থেকে মুক্ত করে দিলেন। ভেঙে দিলেন যাবতীয় বাঁধ আর গোপন ফিসফাসের চক্রান্ত। লেখক আর পাঠকের মধ্যে তৈরি হল একান্ত বোঝাপড়ার এক সেতু। পাঠক পাঠবস্তুটির হয়ে উঠলেন পুনর্লেখক, পুনর্নির্মাণকারী। একেই তাঁরা বললেন সাহিত্যের পরিশুদ্ধ ভাষ্য বা বয়ান।
রন্ধনশালা উপন্যাসের লেখক বাসুদেব দাশগুপ্তের গল্প ‘অভিরামের চলাফেরা’ তে অভি্রাম, যে গল্পের নায়ক বা কথক তার জীবনে না-পাওয়ার বেদনাকে চিত্রিত করেন পরম স্নিগ্ধ মমতায়। তার বন্ধুরা কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত, কেউ বা চাকরি খুঁজছে হয়রান হয়ে। তারা সবাই ওর শুভাকাঙ্খী। কিন্তু অভিরামের জীবনে আলোর অভাব। অভাব বা বেরোজগার নিয়েও বন্ধুরা কেমন সাংসারিক হাসি ঠাট্টায় নিয়োজিত থাকতে পারে বা তেমন সুযোগ পেলে নারীসঙ্গও করে নেয়। নেশা তো চলতে থাকে অহরহই। অভি কোনোটিতেই তার মনোবাঞ্ছা পূরণের সমাধান মানতে পারে না। ফলে একাকী নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া তার ভবিতব্য। শেষ দৃশ্য, যেখানে অভি তার একান্ত আশ্রয় দিদির বাড়িতে যাওয়ার জন্যে বেরোলে ফেকু নামের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে দিদির বাড়ির যাত্রা বাতিল করে। ফেকু তাকে সুবোধের কথা বলে। যে সুবোধ থাকলে মদ্যপান ও বারনারী সহজে মিলে যায়। তারপর তারা তিনজনে সবিতা নাম্নী এক বারবণিতার সঙ্গে নাচে, মদ্যপান করে। ফেকু সবিতাকে পেতে চেয়েও পারে না, বলে, ‘ আজ বেশি পসা নেই সবিতা। সুবোধ থাকুক। আমরা দুজন বাইরের বারান্দায় দাঁড়াচ্ছি।’ তারপর তারা বন্ধ দরজার ভেতর ওদের রেখে বাইরে এসে দাঁড়ায় আর মদের ঘোরে ফেকু বানিয়ে বানিয়ে তার প্রেমকাহিনি বিবৃত করে ও অভিকে শোনায়। অভি জানে ফেকু নিজের অভাবকে, নিরুপায়তাকে আড়াল করার জন্যে বন্ধুর কাছে না-হারার গপ্পো ফেঁদেছে। এরপর লেখকের অমোঘ বর্ণনা--
“ হঠাৎ ফস করে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘মেয়েটার নাম কী রে?’ ফেকু থতমত খেয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলে-- ‘যাক গে, বাজে যত্তোসব।’ কিন্তু ওরা বেরোচ্ছে না কেন? ...খড়খড়ি তুলে ফেকু আর আমি চোখ রাখি। কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না।...শুধু নীল অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। চারিদিকে দৃষ্টি ফেলি।... ঘন নীল...ঘন নীল... অন্ধকারের ঢেউ এসে আমাদের চোখে অনবরত আঘাত করে। ফেকু বলে--‘দেখা যায় না কেন? কানা নাকি? অ্যাঁ, আমরা কানা...? অন্ধা...?--’ আমার গোটা শরীর কাঁপতে শুরু করে, ফিসফিস করে বলি---‘কী বলছিস তুই?’ ফেকু আমার হাত ধরে আরও কাছে টেনে আনে, বলে--‘দ্যাখ না চেয়ে ভালো করে।’ পরক্ষণেই ভীষণভাবেই চমকে ওঠে--‘ তোর হাত এত ঠান্ডা কেন রে?’ (অভিরামের চলাফেরা, অখণ্ড জেব্রা, পৃ-১৩০)
বাসুদেব তখনই আমাদের বোঝাতে পেরেছিলেন আঁধার, বিশেষত তা যদি কামনামদির অশিষ্ট ধাঁচের হয়—তার রঙ নীল! ষাটের দশকের এক বিক্ষুব্ধ সময়ে দাঁড়িয়ে এই লেখায় এমন আকাঁড়া যৌনতাকে আর কে-ই বা আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে! বলিষ্ঠ লেখকদের কলমে যখন তথাকথিত স্বাধীনতার পর দেশ গঠনের ডাক, নিজেদের যাপনচিত্রকে গুছিয়ে নেওয়ার জোরালো আহবান, তার পর পরেই কিন্তু সে মোহ কাটতে সময় নিল না। আর সেই দারিদ্র্যপীড়িত স্বদেশের ওপর চাপানো সুশীল মোড়কটিকে টেনে হিঁচড়ে নিখাদ অবস্থানটি মেলে ধরলেন যথার্থ সমাজ-শিল্পীর ঢঙে। ফলত যতই অশ্লীল বলে দেগে দেওয়া হোক না হাংরিদের সাহিত্যকৃতি--মানবিক অবলোকনে তা সমাজ সংস্কারকের একেকটি ইস্তেহার। লেখায় চরিত্রদের রক্ত-ঘাম-বীর্য-শ্লেষ্মা উঠে এসেছে সাবলীল ভঙ্গিতে, চাঁছাছোলা ভাষায় রাখঢাকহীন। উক্ত গল্পের কথক, বাবলি ফেকু অরুণা বা সেই দেহোপজীবী, সকলেই যেন বা ভীষণ এক চক্রের শিকার, যার নাম মধ্যবিত্ত মনন, যেখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় নেই। পেতে হলে যেটুকু ছেড়ে দিতে হয়, তা কারোরই ক্ষমতায় কুলোয় না। এই লেখকের ‘রিপুতাড়িত’ গল্পটিতেও একইভাবে যৌনকামনা এবং অতৃপ্তির বয়ান ঘুরেফিরে আসে। বেকার যুবক, ছাত্র, দেহোপজীবী কোনো ভিন্ন এলাকার বাসিন্দা নয়—সকলেই ওই জীর্ণ সময়ের ফসল। অভাবের তাড়না সেখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয়। বস্তুত এই দশক থেকে মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা নতুন ভাবে লেখা হতে থাকে। আমরা দেখি প্রায়শ লেখকদের লেখায় বন্ধুতা একটি কমন এজেন্ডা। তারা একসঙ্গে সিগ্রেট ভাগ করে খায়, শুঁড়িখানায় যায়, নারী-শরীরও শেয়ার করে। তারপর তাদের জীবনে আসে মর্মন্তুদ ভাঙন। সাধ আর সাধ্যের টানাপোড়েন ঘুচতে চায় না কিছুতেই। মধ্যবিত্ত জীবনের ছাঁচ তৈরি হতে থাকে আবার ভেঙে ফেলা চলতে থাকে ষাটের লেখকদের হাতে। হাংরিরা এর আগাপাশতলা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াসী হন।
হাংরিদের অন্যতম যোদ্ধা সুবিমল বসাকের লেখায় দেশ ছেড়ে, পরিজনকে পেছনে ফেলে অনির্দিষ্ট এলাকায় করুণাপ্রার্থী উদবাস্তু হয়ে আসা জীবন অনেকটাই উন্মোচিত হতে দেখি। ঋত্বিক ঘটকের হাত ধরে যেটুকু আমরা উপলব্ধি করি, তার বিস্তৃত ভূখণ্ড যেন গড়ে তোলেন সুবিমল। ‘ছাতামাথা’ উপন্যাসের লেখক নিজের কথ্য ভাষায় লেখেন তাঁর গল্প-উপন্যাস। আমাদের সামনে এক সাবলটার্ন জগতের উদ্ভাসন, ভাষা-নৈরাজ্যের এক চমৎকার সম্ভাবনা গড়ে উঠতে দেখি। তাঁর লেখা পড়ি : “ঐ পাড় থিক্যা গাড়ির কন্ডাকটর আইয়া খাড়ায়। পিরণের জেব থিক্যা এউগা সুকি বাইর কইর্যা অর হাতে দিয়া টিকিট চাই। পয়সা হাতে লইয়া হে কতোক্ষণ চুপ থাহে, তারপর জিগায়—কোথায় যাবেন? অর চ্যারার দিকে থতমত চাইয়া থাকি আমি। কতোক্ষণ আর মুখ দিয়া কথা বাইরয় না। ভোন্দার ল্যাহন ফ্যালফ্যালাইয়া চাইয়া থাকতে, হে এইবার ধমকানি দিয়া উটে--কোথায় যাবেন? আচিনার লেহান চাইয়া থাকি তবুও, কোনো রাস্তার নাম মনে আহে না।”
উদ্দেশ্যহীন পথচলায় ক্লান্ত এক মানুষের এ আশ্চর্য প্রতিবেদন। যাদের জীবনের লক্ষ্য ফুরিয়ে এসেছে, স্বপ্নেরা আর বেঁচে নেই, উত্তরণের পথ ঝাপসা...দিশাহারা মানুষ, কিংবা রক্ত-মাংস নিয়ে চলাফেরা করা একেকটা সত্তাহীন জীবন।
“ কিছুতেই আর নাম মনে আহে না, কী নাম এক্কেরে স্মরণে আহে না। বেবাক কিছু ভুইল্যা খাইছি। মায়্যাটা আমার মুহের দিকে যাইয়া আছে, আমি ঠোঁটের তলায় দাঁত দিয়া কামড়াইয়া মনে করতে চ্যাষ্টা করি। ঠোঁটের চামড়ায় দাঁত বইয়া যায়, ব্যথা লাগে। খিড়কি দিয়া আমার চ্যারার উপর রোদ আইয়া বিন্দে, সমস্ত শরীল চিরচিরাইয়া উঠে। দুই হাতে আমার মাথা টিপা ধরি, কপাল লাড়া দিই—কিছুতেই আর মনে পড়ে না।...
মূর্ত হয়ে ওঠে স্রোতের প্রতিকূলে চলা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়া এক মানুষের দৈনন্দিনতা। যার কাছে ঐতিহ্য, আকাঙ্ক্ষা, সৌন্দর্যময়তা, প্রেম ইত্যাকার শুভচিহ্ন; একেকটা মৃত আত্মার সমতূল্য।
হাংরিদের লেখা তাই একজন না-লেখকের, একজন প্রতিলেখকের। জীবনচর্যার কথা তাঁরা লেখেন, বানিয়ে গপ্প রচনার ধারেকাছে সেগুলো যায় না। এঁদের তথাকথিত লেখক হওয়ার মনোবাঞ্ছা কোনোদিনই চাগিয়ে ওঠেনি। ইতিহাসে নথিভুক্ত হওয়া নয়, ভাষার সাংস্কৃতিক ভূগোলকে বিশদ করার কাজে ছিলেন শহিদসুলভ নিবেদিতপ্রাণ। শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, সুভাষ ঘোষ প্রমুখের লেখায় জায়মান সেসব আত্মচরিত, আত্মবিলাপ কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বাইরে নয়। এঁদের সকলের লেখা নিয়ে বলার মতো পরিসর এখানে নেই। শেষ করি হাংরিদের মধ্যে নিজস্ব সীমানা ডিঙানোর কারিগর মলয় রায়চৌধুরীর লেখা এবং লেখা সম্পর্কে অজস্র ধারণার মধ্য থেকে কয়েকটি উদাহরণ টেনে।
“ কুড়ি বছর আগে শহরের উদাসীন রেলস্টেশনের সামনে চকচকে দুপুরের রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিলুম ফরসা যুবতীর কাটা তর্জনী, রক্তহীন, কাঁচের রঙের নীলচে নেলপালিশ, সোনার অলস আংটিতে গরম পদ্মরাগমণি ঠায় জেগে, যে-চুনিতে আজও গ্রীষ্মকালীন কেনিয়ার বহুচারী যুবকসিংহের থাবার থমথমে গন্ধ আমাকে দু-তিনশো বছর আগে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যখন আরা বালিয়া বা ছাপরা থেকে আমার কেঁদো পূর্বপুরুষরা পাকানো চামড়ার চাবুক খেতে আর অর্ধাহারেথাকার জন্যে কালোদের দ্বীপে জাহাজবন্দী কেনা গোলাম হয়ে গিয়েছিলেন।”
অংশটি মলয়ের একটি গল্পের, (অলৌকিক দাম্পত্য, ১৯৯২) যেখানে একটিমাত্র বাক্যে আমি নামক অস্তিত্বের প্রায় সবকটি ইতিপূর্বে অনুল্লেখিত দিক উন্মোচিত হতে দেখি। গল্পটি পুরো পড়তে পড়তে জানা যাবে যে- নারীর কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি একটি মৃতদেহ। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অঙ্গাবশেষ, যা পিঁপড়েদের আপাত-খাদ্য। ‘পিঁপড়ের সারি রসদ নিয়ে ফিরছে নিজস্ব জীবনযাপনের সমাজে।’ এবং সেই দেহ এই আঙুল তথা বাহু দিয়ে ‘আমি’কে জড়িয়ে রেখেছে আষ্ঠেপৃষ্ঠে। পাঠক হিসেবে আমাদের চিত্ত প্রসন্ন হওয়ার বদলে আচমকা ঝাঁকুনি খায়। অভ্যস্ত নারী চরিত্র আমাদের পাঠ-আহ্লাদ দান করে। নারীচরিত্রের সাধারণ লেখককৃত শারীরিক বর্ণনায় আমরা বুঁদ হতে থাকি। কিন্তু এই পাঠকৃতি একেবারে বিপরীত অবলোকন থেকে এগোয়, আমাদের পীড়িত করে। হয়তো বা ঘিনঘিনে ধারাবিবরণীর পরেও বিতৃষ্ণা পেরিয়ে একপ্রকার শ্রদ্ধা জেগে রয় সেই নারী এবং এক অলৌকিক দাম্পত্যের জন্যে।
মলয় তাঁর লেখায় নিজস্ব জগত তৈরি করেন, যা একেবারেই অচেনা। তাঁর কোনো লেখাই অন্যের প্রতিরূপ বা ক্লোন নয়। তিনি জানিয়েছেন, “ প্রশ্ন উঠতে পারে, শিল্প-বিরোধিতার নাম করে আমি কি একটি বিকল্প দিচ্ছি নাকি! না। আমি যে বিকল্প পদ্ধতি দিচ্ছি না তা পরিষ্কার হবে এই গ্রন্থের প্রতিটি গদ্য থেকে। প্রতিটি গদ্য, একটি আরেকটি থেকে, সমস্ত দিক দিয়ে আলাদা। কোনো গদ্যে কোনোরকম তত্ত্ব বিক্কিরি করা হচ্ছে না।...প্রতিটি গদ্যে একটিই কণ্ঠস্বর শোনাবার, তত্ত্ব-নির্ভর লেখকেরা যা করেন, তেমন চেষ্টা করা হয়নি। ফলে চরিত্রগুলো নিজেরা নিজেদের গুরুত্বহীনতায় ভুগতে বাধ্য হয়, যেমনটা দেখতে পাওয়া যায় এখনকার ব্যবস্থায়, তা সে রাষ্ট্র বলুন, সমাজ বলুন বা সংস্কৃতিই বলুন। একে বলা যেতে পারে, এই ব্যবস্থাটির ইথসকে সাহিত্যিক স্ট্র্যাটিজি হিসেবে অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে প্রয়োগ।” (ভূমিকা : আত্মপক্ষ, ভেন্নগল্প, ১৯৯২)
মলয়ের এই ‘সাহিত্যিক স্ট্র্যাটিজি’ পরবর্তী কালে নিজস্ব এক ভাষাজগৎ সৃষ্টি করে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। অপরূপ এক শব্দবন্ধ তাঁকে সৃষ্টি করতে দেখি বিভিন্ন লেখায়। যেমন, এক পোঁচ ফরসা, তেএঁটে, যাদুখোকন, লিচুকুসুম, হুড়দংগ, ভজগট, ঝমাঝ-ঝম, হ্যাঙ্গাম, দোগলা ইত্যাদি। প্রাবন্ধিক অরবিন্দ প্রধান জানাচ্ছেন, “... শব্দ কীরকম খলবলিয়ে ওঠে তার ভাষা বিভঙ্গে সেটি এখানেই কর্ঙোচর হয়। সে পাঠকের দৃষ্টিতে তার অনুভবে যেভাবে মাত্রা পায়, অথবা লেখক সাপেক্ষে যেমত অভিব্যক্তিটা বোঝানোর বা ধরানোর চেষ্টা।” ( মলয় রায়চৌধুরী ও শব্দমাহাত্ম্য, কবিতীর্থ, সেপ্টেম্বর-২০১৮ )
হাংরি আন্দোলন সূচিত হয়েছিল কবিতার মুক্তি বিষয়ক সিদ্ধান্ত নিয়ে। ক্রমশ তা তাঁদের গদ্যের অবলম্বন হয়ে ওঠে। গদ্য সম্পর্কে, তার নির্মাণ বা বিনির্মাণ সম্পর্কে তাঁদের খুব বেশি আলোচনা চোখে পড়ে না। মলয়ের বেশ কিছু প্রবন্ধ থেকে যার আঁচ কিছুটা পাওয়ার সুযোগ ঘটে। সুতরাং আমাদের মতামতও সীমায়িত রাখতে হয় নিজস্ব পঠন-পাঠন ও অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে।
Comments